আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় ইউডা

আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় ইউডা

মূল ফিচারটি পড়ুন আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় ইউডা

শুধু খরচই কম নয়, আছে অনেক বৃত্তি। লেখাপড়ার মানোন্নয়নের জন্য একটি কমিটি সব সময় কাজ করছে। প্রতিটি ক্লাসরুমে সিসিটিভি, মাল্টিমিডিয়া ও এসি আছে। হার্ভার্ডসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) সাবেক ছাত্র-ছাত্রীরা। তাঁদের চাকরির বাজারও ভালো। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো গল্প নিয়ে এবারের বিশেষ আয়োজন। লিখেছেন মুতাসিম বিল্লাহ নাসির। ছবি তুলেছেন তারেক আজিজ নিশক

‘ধানমণ্ডি এলাকায় জীবনযাপনে অনেক খরচ। অথচ এখানেই এত কম খরচে লেখাপড়া করা যায় জানতামই না। এক আত্মীয় প্রথমে আমাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলেছিলেন, বিশ্বাস করতে পারিনি। ভর্তি হওয়ার পর দেখলাম, অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় ইউডায় খরচ অনেক কম।’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হাসতে হাসতে কথাগুলো বলছিলেন আফসানা। তিনি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। পড়েন কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সপ্তম ব্যাচে। তাঁর কথার রেশ ধরে একই বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারের ছাত্র সাকিব বললেন, ‘আমাদের বেতন অন্য সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেশ কম। ভালো ফলাফল করতে পারলে প্রতি মাসে শিক্ষাবৃত্তি আছে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা ভালোভাবে লেখাপড়া করতে উৎসাহী হয়। লেখাপড়া নিয়ে বলতে গিয়ে কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান মাহবুব আলম বললেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষা উন্নয়ন ও মাননিয়ন্ত্রণ কমিটি’ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকরা এই কমিটির মাধ্যমে শিক্ষাদান পদ্ধতির মানোন্নয়নের জন্য কাজ করেন। কমিটির মাধ্যমে প্রতি সেমিস্টারের শুরুতে কোর্স শিক্ষকরা কোর্স মডিউল, লেকচার শিট, রেফারেন্স বইয়ের তালিকা, ল্যাব শিট তৈরি করেন। বিভাগী প্রধান ও অনুষদের ডিনদের মাধ্যমে সেগুলো এই কমিটি অনুমোদন করে। প্রথম ক্লাসেই সেগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে দেওয়া হয়।’ এই বিভাগের অন্যতম শিক্ষক বারেক কায়সার বললেন, ‘প্রতিটি ক্লাসের প্রথম ৩০ মিনিট আগের ক্লাসের সমস্যাগুলোর সমাধান দেওয়া হয়। এরপর লেকচার শিটের ওপর আলোচনা হয়। বাকি ৬০ মিনিট সেদিনের লেকচার দেওয়া হয়। প্রতিটি কোর্সে ছাত্র-ছাত্রীরা অন্তত তিনটি টিউটরিয়াল, দুইটি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয় ও একটি করে প্রেজেন্টেশন করে। সব ক্লাসেই সিসি ক্যামেরা, মাল্টিমিডিয়া ও এসি আছে।’ লেখাপড়ার খরচ কেমন? এ প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি মুনির আহমেদ জানালেন, ‘চার বছরের অনার্সে এক লাখ ৭৬ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা লাগে। তবে আমরা অনেক সুবিধা দিই। প্রতি সেমিস্টারে ৩.৫ ও এর বেশি সিজিপিএ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সন্তান, প্রত্যন্ত এলাকার মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থী, আদিবাসীদের জন্য বৃত্তি আছে। এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মেধাবৃত্তি দেওয়া হয়। শিল্প-সাহিত্যের যেকোনো শাখায় পারদর্শী হলে বা খেলাধুলায় ভালো করলে বৃত্তি আছে।’ আর দরিদ্র ও অসচ্ছল ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দেন। এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছেলে-মেয়েরা বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পায়। গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার জন্যও বৃত্তি দেওয়া হয়।’

ইউডার আবাসিক সুবিধাও বেশ ভালো। ঢাকার লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, শংকর, শেখেরটেকে ১০টি হোস্টেল আছে। ধানমণ্ডি হোস্টেলের ফার্মাসির মাস্টার্সের ছাত্রী জোবায়দা বৃষ্টি জানালেন, ‘মেয়েদের হোস্টেলগুলো মহিলা শিক্ষকরা পরিচালনা করেন। থাকা-খাওয়ার জন্য মাসে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা লাগে। সন্ধ্যার মধ্যে হোস্টেলে ফিরতে হয়, অতিথিরা গেস্টরুমে বসেন। শুধু মায়েরাই মেয়েদের রুমে আসতে পারেন।’ ছেলেদের একটি হোস্টেলের বাসিন্দা ইংরেজির ছাত্র শামীম বললেন, ‘আমাদের খাবারের মান ভালো। হোস্টেলে ধূমপান করা যায় না। শিক্ষকরা নিয়মিত কোনো ছাত্র অবৈধ কোনো কাজে জড়িয়ে পড়েছে কি না সেই খোঁজ রাখেন।’

প্রতিটি বিভাগে ইংরেজিমাধ্যমে ক্লাস হয়। ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রথম সেমিস্টারের সব ছাত্র-ছাত্রীকে বাধ্যতামূলক ফাউন্ডেশন কোর্স করতে হয়। এ ছাড়া তারা ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের মাধ্যমে ইংরেজি শিখতে পারে। প্রতি সেমিস্টার চার মাসের, ১২ সেমিস্টারে অনার্স কোর্স শেষ হয়। শেষ সেমিস্টারে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে ইন্টার্নশিপ করতে হয়। অনার্সের শেষ বছরকে ইউডায় প্রফেশনাল ইয়ার বলা হয়। সে বছর ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়ার পাশাপাশি নানা প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, সেমিনারে অংশ নেন। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কম্পানিগুলোয় গিয়ে বাস্তব কর্ম-অভিজ্ঞতা লাভ করে। বিশ্ববিদ্যালয় তাদের এসব সুবিধার ব্যবস্থা করে। লেখাপড়ার প্রতি এত গুরুত্ব দেওয়ার ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের ফলাফল বেশ ভালো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি বললেন, ‘বিশ্বের নামকরা ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছেলে-মেয়েরা গবেষণা করছে। হার্ভার্ডে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই ছাত্র আরিফুল ইসলাম ও নুরুন্নবী পোষ্ট-ডক্টরাল ফোলোশিপ করছেন। আর পাস করেই অন্যরা চাকরি পাচ্ছে। ফার্মাসি, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ, সিএসসি বিভাগের চাকরি করছে। জীববিজ্ঞান অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীরা বিদেশে ভালো করছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটিও বেশ ভালো। এখানে ১৩০ জন ছাত্র-ছাত্রী একসঙ্গে লেখাপড়া করতে পারে। আছে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার রেফারেন্স বই, জার্নাল, ম্যাগাজিন। মানসম্পন্ন গবেষণার জন্য অনেক গবেষণাগার আছে এখানে। প্রকৌশল অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আছে আধুনিক কম্পিউটার প্রগ্রামিং, ইলেকট্রনিকস, ডিজিটাল ইলেকট্রনিকস ও কমিউনিকেশন ল্যাব। ফার্মাসি বিভাগের জন্য আছে ফার্মাসি, মাইক্রোবায়োলজি, এনিম্যাল হাউস ও টিস্যু কালচার ল্যাব। কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের জন্য আছে ডিজিটাল স্টুডিও ও ল্যাব। আইন ও মানবাধিকার বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আছে মুট কোর্ট। ছেলে-মেয়েদের সৃজনশীল লেখার জন্য কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে প্রতিবছর জার্নাল প্রকাশিত হয়। জীববিজ্ঞান অনুষদ এই পর্যন্ত ৩৮৭টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। সেগুলোর ৩০৭টি গুগল স্কলারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাদের ২১৫টি প্রকাশনা স্কোপাস ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, ৫৮টি যুক্তরাষ্ট্রের বায়োমেডিক্যাল ও লাইফ সায়েন্স বিষয়ে ফ্রি জার্নাল পাবমেডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২৬৮টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে উপস্থাপিত হয়েছে, একটির আন্তর্জাতিক পেটেন্ট আছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণা ও খেলাধুলা নিয়ে প্রতি তিন মাস পর পর নিউজ লেটার নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ইউজিসি অনুমোদিত বলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ছাত্র-ছাত্রী দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রেডিট ট্রান্সফার করতে পারে। তেমনিভাবে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এখানে পড়তে আসতে পারে। এখন ইউনিভার্সিটি অব কেমব্র্রিজ, যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটি, ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি, কোরিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব ট্রান্সপোর্টেশন, ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব নটিংহামের মালয়েশিয়া ক্যাম্পাস, যুক্তরাষ্ট্রের প্রোমেগা করপোরেশন (জৈবপ্রযুক্তি ও আনবিক জীববিদ্যার এনজাইম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান), ইতালির ইউনিভার্সিতা পলিটেকনিকা দেল্লে মার্চের সঙ্গে শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রম চালু আছে।

বিভিন্ন বিভাগে খ্যাতনামা শিক্ষকরা এখানে শিক্ষাদান করছেন। লাইফ সায়েন্সের ডিন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক ড. মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ, কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক, অধ্যাপক ড. আহমদুল্যাহ মিঞা, প্রকৌশল অনুষদের ডিন আর আই খান, আইন অনুষদের ডিন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর লতিফুর রহমান।

 

Share it: